সূরা আল-ফাতিহা পবিত্র আল কোরআনের প্রথম সূরা। এই সূরার দ্বারা মহান আল্লাহর বিধি-বিধান, হুকুম-আহকাম, হালাল-হারামসহ যাবতীয় দিক-নির্দেশনার ভাণ্ডার কোরআন শুরু হয়েছে। আর এ কারণেই সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে- সূরাতুল ফাতিহা। একই কারণে সূরাটি প্রথমে কোরআনের প্রথমে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই সূরা আয়াত সাতটি এবং এই সূরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়। ‘ফাতিহা’ শব্দের অর্থ শুরু, আরম্ভ, উদ্বোধন, উদঘাটন প্রভৃতি। কুরআনুল কারিমের ১১৪টি সূরার মধ্যে প্রথম সূরাটি হলো সূরাতুল ফাতিহা। আর এ জন্য সূরা ফাতিহাকে ‘ফাতিহাতুল কুরআন’ বা কুরআনের শুরু বলে অভিহিত করা হয়।
এ সূরার আরেকটি নাম হলো “সাবউ মছানী”। অর্থাৎ এ সূরাটিতে রয়েছে অনুপম সাতটি বাণী বা আয়াত। এ সূরার আরেকটি নাম “আলহামদু শরীফ”। সূরায়ে ফাতেহার আরেকটি নাম হচ্ছে “উম্মুল কোরআন” বা পবিত্র কোরআনের সার সংক্ষেপ। পুরো কোরআন শরীফের সারবস্তু সূরায়ে ফাতিহায় নিহীত বা পুরো কোরআন শরীফ হলো সূরায়ে ফাতিহার ব্যাখ্যা। এ সূরা নাজিল হয়েছে মানুষের সার্বিক কল্যাণ মুক্তি ও পথপ্রদর্শক হিসেবে। সূরাটি ফজিলত ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অন্য সব সূরা থেকে আলাদা।
সূরা ফাতিহার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য :
১) এই সূরা কোরআনের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ সূরা। তাওরাত, যাবুর, ইনজিল, কোরআন কোনো কিতাবে এই সূরার তুলনীয় কোন সূরা নেই। (বুখারি, মিশকাত : ২১৪২)
২) এই সূরা এবং সূরায়ে বাকারা’র শেষ তিনটি আয়াত হল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত বিশেষ নূর, যা ইতিপূর্বে কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি। (মুসলিম শরীফ : ৮০৬)
৩) যে ব্যক্তি নামাজে সূরা ফাতিহা পাঠ করলো না, তার নামাজ অপূর্ণাঙ্গ। রাসূল (সা.) এ কথাটি তিনবার বললেন। (মিশকাত : ৮২৩)
৪) হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, একবার এক সফরে আমাদের এক সাথী জনৈক গোত্রপতিকে শুধুমাত্র সূরায়ে ফাতিহা পড়ে ফুঁ দিয়ে সাপের বিষ ঝাড়েন এবং তিনি সুস্থ হন। (বুখারি শরীফ : ৫৪০৫)
সুরা ফাতিহার বিশেষ মর্যাদা হলো, আল্লাহ এটিকে নিজের ও নিজের বান্দার মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। একে বাদ দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। সেজন্যই এর নাম দেয়া হয়েছে ‘উম্মুল কুরআন’। পবিত্র কুরআন মূলত তিনটি বিষয়ে বিন্যস্ত: তাওহীদ, আহকাম ও নসিহত।
সূরায়ে ইখলাসে ‘তাওহীদ’ পূর্ণাঙ্গভাবে থাকার কারণে তা কোরআনের এক তৃতীয়াংশের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু সূরায়ে ফাতিহায় তিনটি বিষয় একত্রে থাকার কারণে তা ‘উম্মুল কোরআন’ হওয়ার মহত্তম মর্যাদা লাভে ধন্য হয়েছে। (তাফসীরে কুরতুবী : ১৪৮)
সুরা ফাতিহার বাংলা উচ্চারণ:
১. আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন
২. আর রাহমানির রাহিম
৩. মালিকি ইয়াওমিদ্দিন
৪. ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তায়িন
৫. ইহদিনাছ ছিরাতল মুস্তাকিম
৬. ছিরাতল্লাজিনা আনআমতা আলাইহিম
৭. গয়রিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্দল্লিন।
সুরা ফাতিহার অর্থ:
১.সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহরই।
২.যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময়;
৩.বিচার দিনের মালিক।
৪.আমরা তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি;
৫.তুমি আমাদের চালিত করো সঠিক পথে,
৬.তাঁদের পথে, যাঁদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছ,
৭.যারা (তোমার) রোষে পতিত হয়নি, পথভ্রষ্ট হয়নি।
এই সাতটি আয়াতের মধ্যে প্রথম তিনটি আয়াতে আছে আল্লাহর পরিচয়। আর শেষ তিন আয়াতে আছে আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা।
আল্লাহর পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়; কারণ তিনিই মহাবিশ্বের প্রতিপালন করছেন। তাই তিনিই আমাদের মাফ করে দেওয়ার চূড়ান্ত অধিকারী। তিনি যেহেতু বিচার দিবসের প্রভূ, সেই বিচারে তিনিই আমাদের প্রতি দয়া বর্ষণ করার একমাত্র ত্রাণকর্তা।
সুরাটির শেষ তিন আয়াতের প্রথমেই আল্লাহর কাছে আমরা সরল পথ দেখিয়ে দেওয়ার পথনির্দেশ চাচ্ছি। কোন পথ সরল? আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসুলকে যে পথে চালিত করেছেন। এটি হলো আল্লাহর কাছে আমাদের প্রত্যাশা। যিনি নবী-রাসুলদের পথ দেখিয়েছেন, তিনি ছাড়া আমাদের কে আর সর্বোত্তম পথ দেখাতে পারেন!
সুরাটির পঞ্চম আয়াতে বলা হচ্ছে, তুমি আমাদের সরল পথ দেখাও। এর পরেই কথাটি আরেকটু বিশদ করে পর পর দুই আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ যাঁদের পরম অনুগ্রহ করেছেন, তাঁদেরকে দেখানো পথটিই হলো এ সরল পথ। কারা আল্লাহর এই অনুগ্রহ পেয়েছেন? যাঁরা পথভ্রষ্ট হননি। এ জন্য তাঁরা আল্লাহর ক্রোধেরও শিকার হননি।
প্রথম অংশে আল্লাহর পরিচয় আর শেষ অংশে আল্লাহর কাছে আমাদের প্রত্যাশার মাঝখানে বলা হয়েছে, ‘ইয়া কানা বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন।’ অর্থাৎ, ‘আমরা তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ এই আয়াতকে বলতে পারি আল্লাহর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। তাঁর কাছে আমাদের নিঃশর্ত আত্মনিবেদনের সম্পর্ক। আমাদের একমাত্র ইবাদত আল্লাহরই প্রতি। সব সাহায্যও আমরা তাঁর কাছেই চাই।
সুরা ফাতিহার ফজিলত:
একবার মহানবী (সা.) একদল সাহাবিকে একটি সামরিক অভিযানে পাঠালেন। দীর্ঘদিনের পথ। পথে সাহাবিরা একটি লোকালয় খুঁজে পেলেন। তাঁরা ভাবলেন, কিছুদিন এখানে বিশ্রাম নেওয়া যাবে। লোকালয়ের মানুষ সাহাবিদের মোটেও ভালো চোখে দেখল না। তারা কোনো সাহায্য তো করলই না, তার ওপর খুবই রুক্ষ ও অমানবিক আচরণ করল। সাহাবিরা সিদ্ধান্ত নিলেন এখানে এক রাতের বেশি থাকা ঠিক হবে না। কাল সূর্যোদয়ের আগেই রওনা দিতে হবে।
সেই রাতে লোকালয়ের গোত্রপ্রধানকে এক বিষাক্ত সাপে কামড় দিল। লোকালয়ের চিকিৎসকেরা হাজার চেষ্টা করেও বিষ নামাতে পারল না। বিষ নামানো না গেলে মৃত্যু নিশ্চিত। এবার লোকজন বাধ্য হয়ে নবী (সা.)-এর সাহাবিদের কাছে এসে বলল, ‘আপনাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে সাপের বিষ নামাতে জানে? আমাদের এক দলনেতাকে সাপে কামড় দিয়েছে।’
একজন সাহাবি বলে উঠলেন, ‘আমরা আপনাদের কাছ থেকে কোনো ভালো আচরণ পাইনি, তবু চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদি তিনি সুস্থ হন, তবে এর বিনিময় কী হবে?’
লোকালয়ের লোকেরা বলল, ‘যে আমাদের দলনেতাকে সুস্থ করতে পারবে, তার জন্য ৩০টি বকরি পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়েছে।’
সাহাবিরা রাজি হলেন। তাঁরা দলনেতার পাশে গিয়ে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা শুরু করলেন: ‘সব প্রশংসা শুধু আল্লাহর, যিনি জগৎসমূহ প্রতিপালন করেন। যিনি দয়াময় ও পরম দয়ালু। যিনি বিচার দিবসের মালিক। আমরা শুধু আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই। আপনি আমাদের সরল সঠিক পথ দেখান। তাদের পথ, যাদের আপনি অনুগ্রহ করেছেন। তবে তাদের পথে নয়, যাদের প্রতি আপনার শাস্তি বর্ষিত হয়েছে, যারা পথভ্রষ্ট। আমিন।’
কিছু বর্ণনা অনুযায়ী, তারা সাতবার সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করেছিলেন। তারপর সামান্য থুতু নিয়ে ক্ষতস্থানে মেখে দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরই লোকালয়ের দলপতি সুস্থ অনুভব করতে লাগলেন। তিনি রোগমুক্ত হয়ে গেলেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাহাবিদের ৩০টি বকরি পুরস্কার দেওয়া হলো।
ফিরে আসার পথে এক সাহাবির মনে হলো, আচ্ছা এ বকরিগুলো তো আল্লাহর আয়াত ব্যবহার করে পেয়েছি। এগুলো খাওয়া কি হালাল হবে?
এরপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন কিছু করার দরকার নেই। আগে মদিনায় ফিরে যাওয়া যাক। মহানবী (সা.) এ ব্যাপারে কী বলেন, তা জানা প্রয়োজন। সাহাবিরা মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে সবকিছু খুলে বললেন।
মহানবী (সা.) এ ঘটনা শুনে অবাক হলেন। তিনি বললেন, ‘তোমরা কী করে জানলে যে সুরা ফাতিহা দিয়ে রোগের চিকিৎসা হয়? আমি তো এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি।’ এরপর মহানবী (সা.) হাসতে হাসতে বললেন, ‘এগুলো সবার মধ্যে ভাগ করে দাও এবং আমার জন্য একটি অংশ রেখো।’
সাহাবিরা খুশি হয়ে চলে গেলেন এবং বকরিগুলো সবার মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। হাদিসটি আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ শরিফে হাদিসটি রয়েছে।
সূরা ফাতিহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কী বলে?
সূরা ফাতিহা (কোরআনের প্রথম সূরা) কোরআনের সূচনা হওয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্বাচিত হয়েছে, কারণ এটি ইসলামিক প্রার্থনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং মুসলিমদের জীবনে এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে। সূরা ফাতিহার মূল গুরুত্ব এবং তাৎপর্য নিম্নলিখিত কারণে:
১. আল্লাহর প্রশংসা ও শ্রদ্ধা
সূরা ফাতিহা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর প্রশংসা এবং শ্রদ্ধার মধ্যে কেন্দ্রীভূত। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন প্রার্থনা যা আল্লাহর মেহেরবানী, ক্ষমা, রাহমত, হেদায়াত এবং বিচারের প্রতি মুসলিমদের একাগ্রতা প্রকাশ করে। সূরা ফাতিহাতে আল্লাহর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
- রাহমান (অনুগ্রহশীল)
- রাহিম (অত্যন্ত দয়ালু)
- মালিক-ইয়াওম-ইদ-দীন (বিচারের দিনের মালিক)
২. ইবাদতের ভিত্তি
সূরা ফাতিহা প্রতিটি মুসলিমের দৈনিক পাঁচটি নামাজের মধ্যে একবার করে পাঠ করতে হয়। এটি নামাজের প্রথম অংশ হিসেবে প্রার্থনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং নামাজের মধ্যে মুসলিমরা আল্লাহর কাছে তাদের সাহায্য ও পথ নির্দেশনা চেয়ে এই সূরাটি পাঠ করে।
৩. এটা ‘উম্মুল কিতাব’ বা কোরআনের মা
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে সূরা ফাতিহা কোরআনের মা (উম্মুল কিতাব)। এটি কোরআনের মৌলিক দিকগুলির সারাংশ ধারণ করে এবং অন্যসব সূরার অর্থ ও উদ্দেশ্যকে বোঝার জন্য একটি ভিত্তি সরবরাহ করে। সূরা ফাতিহা কোরআনের প্রধান বার্তা – এক আল্লাহর উপাসনা, তাঁর পথ অনুসরণ এবং মানবতার জন্য সঠিক পথের জন্য প্রার্থনা – এই সব বিষয়ের মূল প্রতিফলন।
৪. মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয়তা
সূরা ফাতিহার প্রতিটি বাক্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, বিশেষ করে আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং আল্লাহর সাহায্য লাভের জন্য। এটি মানুষের প্রয়োজনীয়তাকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার এক ধরনের প্রতীক।
৫. আধ্যাত্মিক শান্তি
এই সূরা বিশ্বাসীদের জন্য আধ্যাত্মিক শান্তি প্রদান করে। এটি মনের শান্তি এবং বিশ্বাসের শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, কারণ এর মাধ্যমে মুসলিমরা আল্লাহর কাছে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে এবং তাঁকে নিজেদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করে।
৬. আল্লাহর নির্দেশে প্রার্থনা
“ইহদিনা সীরাতাল মুস্তাকিম” (আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করো) বাক্যটি মুসলিমদের জন্য সঠিক পথের প্রতি এক ধরনের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এটি মুসলিমদের মধ্যে আল্লাহর পথে চলতে ও তাঁর দয়ালু নির্দেশনার দিকে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত করে।
৭. গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় শিক্ষা
সূরা ফাতিহা শুধু একটি নামাজের অংশ নয়, এটি ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই সূরার মাধ্যমে মুসলিমরা শিক্ষা গ্রহণ করেন যে, জীবন-যাত্রার মধ্যে শুধুমাত্র আল্লাহর সাহায্য এবং তাঁর দিকনির্দেশনার উপর আস্থা রাখা উচিত।
এছাড়া, সূরা ফাতিহার মাধ্যমে মুসলিমরা তাঁর সর্বশেষ বিচার দিবসে আল্লাহর সামনে সঠিকভাবে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হন। এটি আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে গণ্য হয়।