এসো শিখি ইসলামঃ

কোরান ও সহীহ হাদীস অনুসারে তাওবা কী? কিভাবে তাওবা করা সঠিক?

কোরআন ও সহীহ হাদীস অনুসারে তাওবা (তওবা) হলো আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহ স্বীকার করে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া, ভবিষ্যতে আর সেই গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা এবং ভালো কাজে ফিরে আসা। তাওবা করা মানে শুধুমাত্র মুখে ক্ষমা চাওয়া নয়, বরং অন্তরের গভীর থেকে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর পথে ফিরে আসা। পবিত্র কোরআনে তাওবার গুরুত্ব উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনের সূরা আল-বাকারা আয়াত ২২২ এ আল্লাহ বলেনঃ

اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ التَّوَّابِیۡنَ وَ یُحِبُّ الۡمُتَطَهِّرِیۡنَ
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে।
Indeed, Allah loves those who are constantly repentant and loves those who purify themselves.

আল্লাহ গুনাহ ক্ষমা করেন। পবিত্র কোরআনের সূরা আয-যুমার আয়াত ৫৩ তে আল্লাহ বলেনঃ

قُلۡ یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ یَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ
অর্থঃ বল- হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।
Say, “O My servants who have transgressed against themselves [by sinning], do not despair of the mercy of Allah. Indeed, Allah forgives all sins. Indeed, it is He who is the Forgiving, the Merciful.”

উপরোক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর মহা ক্ষমাশীলতার কথা বর্ণনা করেছেন। إسرَاف ‘ইসরাফ’ অর্থ পাপের আধিক্য ও তার প্রাচুর্য। `আল্লাহর করুণা হতে নিরাশ হয়ো না’ এর অর্থ, ঈমান আনার পূর্বে অথবা তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে যতই গুনাহ করে থাক, মানুষ যেন এই মনে না করে যে, আমি তো অনেক বড় পাপী, আমাকে আল্লাহ কিভাবে ক্ষমা করবেন? বরং সত্য হৃদয়ে যদি ঈমান আনে বা নিষ্ঠার সাথে যদি তওবা করে, তবে মহান আল্লাহ সমস্ত পাপকে মাফ করে দেবেন।

তাওবা করলে আল্লাহ খুশি হন। সহীহ মুসলিম অধ্যায় ৫০ তাওবাহ্ পরিচ্ছেদ ১ তাওবার প্রতি উৎসাহ প্রদান ও তার মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা, হাদিস একাডেমি নাম্বার ৬৮৫৩ আন্তর্জাতিক নাম্বার ২৭৪৭ এ বর্ণিত হয়েছে:

মুহাম্মাদ ইবনু সাব্বাহ ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) ….. আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তওবা করে তখন আল্লাহ ঐ লোকের চেয়েও বেশি আনন্দিত হন, যে মরুভূমিতে নিজ সওয়ারীর উপর আরোহিত ছিল। তারপর সওয়ারটি তার হতে হারিয়ে যায়। আর তার উপর ছিল তার খাদ্য ও পানীয়। এরপর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় এসে আরাম করে এবং তার উটটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় হঠাৎ উটটি তার কাছে এসে দাঁড়ায়। অমনিই সে, তার লাগাম ধরে ফেলে। এরপর সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠে, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে ভুল করে ফেলেছে।

সুনান ইবনু মাজাহ অধ্যায় ৩১ পার্থিব ভোগবিলাসের প্রতি অনাসক্তি পরিচ্ছেদ ৩১/৩০ তওবা সম্পর্কে আলোচনা হাদীস ৪২৫০এ বর্ণিত হয়েছে:

আবূ উবায়দা ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ গুনাহ থেকে তওবাকারী নিষ্পাপ ব্যক্তিতুল্য।

তাওবা কবুলের জন্য কয়েকটি শর্ত আছে:

  • গুনাহ স্বীকার করা:- নিজের গুনাহকে ভুল হিসাবে স্বীকার করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
  • আন্তরিক অনুশোচনা:- গুনাহ করার জন্য অন্তর থেকে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হতে হবে।
  • গুনাহ ত্যাগ করা:- যেই গুনাহর জন্য তাওবা করা হচ্ছে, তা পুরোপুরি ছেড়ে দিতে হবে।
  • ভবিষ্যতে গুনাহ না করার সংকল্প:- পুনরায় সেই গুনাহে ফিরে না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।
  • প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দেওয়া:- যদি গুনাহ কোনো মানুষের হক নষ্ট করে, তবে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বা ক্ষমা চাইতে হবে।

তাওবার দোয়া:

রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি سيد الاستغفار (সাইয়িদুল ইস্তিগফার) দোয়াটি পড়বে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। সহীহ বুখারী অধ্যায় ৮০ দু‘আসমূহ পরিচ্ছেদ ২ শ্রেষ্ঠতম ইস্তিগফার আল্লাহর বাণী, হাদিস ৬৩০৬ শাদ্দাদ ইবনু আউস (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার হলো বান্দার এ দু’আ পড়া-

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِي، فَاغْفِرْ لِي، فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ۔
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা আনতা রব্বী লা-ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্কতানী ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আহ্‌দিকা ওয়া ও’য়াদিকা মাসতাত’তু আ’উযুবিকা মিন শার্‌রি মা ছা’নাতু আবূউলাকা বিনি’মাতিকা আ’লাইয়্যা ওয়া আবূউলাকা বিযানবী ফাগ্‌ফির্‌লী ফাইন্নাহু লা-ইয়াগফিরুয্‌যুনূবা ইল্লা আনতা”।

অর্থঃ ’হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে কৃত প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নি’য়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।’

যে ব্যক্তি দিনে (সকালে) দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ ইসতিগফার পড়বে আর সন্ধ্যা হবার আগেই সে মারা যাবে, সে জান্নাতী হবে। আর যে ব্যক্তি রাতে (প্রথম ভাগে) দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এ দু’আ পড়ে নেবে আর সে ভোর হবার আগেই মারা যাবে সে জান্নাতী হবে। পবিত্র কোরআনের সূরা নূহ অধ্যায় ৭১ আয়াত ১০ এ বর্ণিত হয়েছে:

فَقُلۡتُ اسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ؕ  اِنَّہٗ کَانَ غَفَّارًا ۙ
অর্থঃ আমি তাদেরকে বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল।
And said, ‘Ask forgiveness of your Lord. Indeed, He is ever a Perpetual Forgiver.

অর্থাৎ, ঈমান এবং আনুগত্যের পথ অবলম্বন করো এবং তোমাদের প্রভুর কাছে নিজেদের বিগত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে নাও। তিনি তাদের জন্য বড়ই দয়াবান এবং মহা ক্ষমাশীল যারা তওবা করে। পবিত্র কোরানের সূরা আল-ইমরান অধ্যায় ৩ আয়াত ১৩৫ এ বর্ণিত হয়েছে:

وَالَّذِیۡنَ اِذَا فَعَلُوۡا فَاحِشَۃً اَوۡ ظَلَمُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ ذَکَرُوا اللّٰہَ فَاسۡتَغۡفَرُوۡا لِذُنُوۡبِہِمۡ ۪ وَمَنۡ یَّغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ اِلَّا اللّٰہُ ۪۟ وَلَمۡ یُصِرُّوۡا عَلٰی مَا فَعَلُوۡا وَہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ
অর্থঃ আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি যুলম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা চায়। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে ? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না।
And those who, when they commit an immorality or wrong themselves [by transgression], remember Allah and seek forgiveness for their sins – and who can forgive sins except Allah? – and [who] do not persist in what they have done while they know.

সহীহ বুখারী অধ্যায় ৯৭ তাওহীদ পরিচ্ছেদ ৩৫. আল্লাহর বাণীঃ তারা আল্লাহর ও‘য়াদাকে বদলে দিতে চায়, হাদীস ৭৫০৭ এ বর্ণিত হয়েছে:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন এক ব্যক্তি গোনাহ করার পর বললঃ হে আল্লাহ! আমি গোনাহ করেছি সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বললেনঃ আমার বান্দা গোনাহ করেছে এবং এটা জেনেছে যে, তার একজন রব আছে যিনি তার গোনাহ মাফ করবে ও তাকে পাকড়াও করবে; আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। তারপর সে আবার আরেকটি গোনাহ করে আবারও বললঃ হে রব! আমি গোনাহ করেছি সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ আমার বান্দা গোনাহ করেছে এবং এটা জেনেছে যে, তার একজন রব আছে যিনি তার গোনাহ মাফ করবে ও তাকে পাকড়াও করবে; আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। তারপর সে আবার আরেকটি গোনাহ করে আবারও বললঃ হে রব! আমি গোনাহ করেছি সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বললেনঃ আমার বান্দা গোনাহ করেছে এবং এটা জেনেছে যে, তার একজন রব আছে যিনি তার গোনাহ মাফ করবে ও তাকে পাকড়াও করবে; আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম, সে যাই করুক না কেন।

তওবা করার পদ্ধতি:
তওবা করার জন্য প্রথমে সুন্দর করে অজু করা চাই। এরপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। গত জীবনের সব পাপ এবং আদেশ অমান্য করার অপরাধ থেকে মার্জনা চাইতে হবে। তবে এই নফল নামাজ তওবার জন্য আবশ্যক নয়। তওবা মৃত্যু যন্ত্রণার আগ পর্যন্ত কবুল হয়।

মূলকথাঃ
👉 তাওবা যতবার করা হোক, আল্লাহ কবুল করেন।
👉 গুনাহ যত বড়ই হোক, আল্লাহর দয়া তার চেয়েও বড়।
👉 তাওবা করা দেরি করা ঠিক নয়, কারণ মৃত্যু যখন আসবে তখন আর সুযোগ থাকবে না।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্যিকারের তাওবা করার তাওফিক দিন। আমিন! 🤲

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *