ইসলামী জীবন: কিয়ামুল লাইল

প্রতি রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রথম আকাশে আসেন

রাত ও দিন আল্লাহ তাআলার বড় দুটি নেয়ামত। দিন আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান ও রাত বিশ্রামের উপযুক্ত। আবার রাতের ইবাদত মহান আল্লাহ অনেক পছন্দ করেন। মুমিন মুত্তাকিদের একটি বিশেষ গুণ হলো- তারা আরামের ঘুমের কিছু অংশ আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করেন।

নবী কারিম (স.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে শুরু করে যুগে যুগে আল্লাহর মকবুল বান্দারা পরকালীন উন্নতির জন্য শেষরাতের ইবাদতকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনের সূরা আয-যারিয়াত অধ্যায় ৫১ আয়াত ১৫ তে বলেন, اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوۡنٍ অর্থঃ নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে জান্নাতসমূহে ও ঝর্ণাধারায়। আয়াত ১৬ তে বলেন, اٰخِذِیۡنَ مَاۤ اٰتٰهُمۡ رَبُّهُمۡ ؕ اِنَّهُمۡ كَانُوۡا قَبۡلَ ذٰلِكَ مُحۡسِنِیۡنَ অর্থঃ গ্ৰহণ করবে তা যা তাদের রব তাদেরকে দিবেন; নিশ্চয় ইতোপূর্বে তারা ছিল সৎকর্মশীল। আয়াত ১৭ তে বলেন, كَانُوۡا قَلِیۡلًا مِّنَ الَّیۡلِ مَا یَهۡجَعُوۡنَ অর্থঃ তারা রাতের সামান্য অংশই অতিবাহিত করত নিদ্রায়।

হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’ সহীহ : বুখারী ১১৪৫, মুসলিম ৭৫৮।

আবূ শায়বাহ-এর দু’ পুত্র উসমান ও আবূ বকর এবং ইসহাক ইবনু ইবরাহীম আল হানযালী (রহঃ) … আবূ সাঈদ আল খুদরী ও আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তারা বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা অবকাশ দেন বা দেরী করেন না। এভাবে যখন রাতের প্রথম এক তৃতীয়াংশ অতিক্রম হয়ে যায় তখন তিনি দুনিয়ার আকাশে নেমে এসে বলতে থাকেনঃ কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি (যে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আর আমি তাকে ক্ষমা করব)? কোন তওবাকারী আছে কি (যে তওবা করবে আর আমি তার তওবা কবুল করব)? কোন প্রার্থনাকারী আছে কি (যে প্রার্থনা করবে আর আমি তার প্রার্থনা কুবুল করব)? কোন আহবানকারী আছে কি (আমি যার আহবানে দিব)? এভাবে ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত তিনি বলতে থাকেন। (ইসলামী ফাউন্ডেশন ১৬৪৭, ইসলামীক সেন্টার ১৬৫৪)

মহান আল্লাহর বিশেষণাবলীর সাথে মানবীয় গুনাবলীর তুলনা করা আমাদের জন্য সঠিক নয়। মনে রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তার সৃষ্টি জগতের কোন কিছুর সাথেই তুলনীয় নয়। আল্লাহর সত্তা যেমন সৃষ্টির মত নয়, তেমনি তার বিশেষনাবলিও সৃষ্টির মত নয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনের সূরা আশ্-শূরা অধ্যায় ৪২ আয়াত ১১ এ ঘোষণা করেনঃ فَاطِرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ جَعَلَ لَكُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِكُمۡ اَزۡوَاجًا وَّ مِنَ الۡاَنۡعَامِ اَزۡوَاجًا ۚ یَذۡرَؤُكُمۡ فِیۡهِ ؕ لَیۡسَ كَمِثۡلِهٖ شَیۡءٌ ۚ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ অর্থঃ তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং গৃহপালিত জন্তুর মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন জোড়া। এভাবে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন; কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

পবিত্র কোরআনের সূরা আল-বাকারা অধ্যায় ২ আয়াত ৯৬ এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করেনঃ وَ لَتَجِدَنَّهُمۡ اَحۡرَصَ النَّاسِ عَلٰی حَیٰوۃٍ ۚۛ وَ مِنَ الَّذِیۡنَ اَشۡرَكُوۡا ۚۛ یَوَدُّ اَحَدُهُمۡ لَوۡ یُعَمَّرُ اَلۡفَ سَنَۃٍ ۚ وَ مَا هُوَ بِمُزَحۡزِحِهٖ مِنَ الۡعَذَابِ اَنۡ یُّعَمَّرَ ؕ وَ اللّٰهُ بَصِیۡرٌۢ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ অর্থঃ আর আপনি অবশ্যই তাদেরকে জীবনের প্রতি অন্যসব লোকের চেয়ে বেশী লোভী দেখতে পাবেন, এমনকি মুশরিকদের চাইতেও। তাদের প্রত্যেকে আশা করে যদি হাজার বছর আয়ু দেয়া হত; অথচ দীর্ঘায়ু তাকে শাস্তি হতে নিষ্কৃতি দিতে পারবে না। তারা যা করে আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।

পবিত্র কোরআনের সূরা আল-বাকারা অধ্যায় ২ আয়াত ২৩৩ এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঘোষণা করেনঃ وَ الۡوَالِدٰتُ یُرۡضِعۡنَ اَوۡلَادَهُنَّ حَوۡلَیۡنِ كَامِلَیۡنِ لِمَنۡ اَرَادَ اَنۡ یُّتِمَّ الرَّضَاعَۃَ ؕ وَ عَلَی الۡمَوۡلُوۡدِ لَهٗ رِزۡقُهُنَّ وَ كِسۡوَتُهُنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ لَا تُكَلَّفُ نَفۡسٌ اِلَّا وُسۡعَهَا ۚ لَا تُضَآرَّ وَالِدَۃٌۢ بِوَلَدِهَا وَ لَا مَوۡلُوۡدٌ لَّهٗ بِوَلَدِهٖ ٭ وَ عَلَی الۡوَارِثِ مِثۡلُ ذٰلِكَ ۚ فَاِنۡ اَرَادَا فِصَالًا عَنۡ تَرَاضٍ مِّنۡهُمَا وَ تَشَاوُرٍ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡهِمَا ؕ وَ اِنۡ اَرَدۡتُّمۡ اَنۡ تَسۡتَرۡضِعُوۡۤا اَوۡلَادَكُمۡ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡكُمۡ اِذَا سَلَّمۡتُمۡ مَّاۤ اٰتَیۡتُمۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ অর্থঃ আর মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে, (এটা) তার জন্য যে দুধ পান করাবার সময় পূর্ণ করতে চায়। আর পিতার উপর কর্তব্য, বিধি মোতাবেক মাদেরকে খাবার ও পোশাক প্রদান করা। সাধ্যের অতিরিক্ত কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় না। কষ্ট দেয়া যাবে না কোন মাকে তার সন্তানের জন্য, কিংবা কোন বাবাকে তার সন্তানের জন্য। আর ওয়ারিশের উপর রয়েছে অনুরূপ দায়িত্ব। অতঃপর তারা যদি পরস্পর সম্মতি ও পরামর্শের মাধ্যমে দুধ ছাড়াতে চায়, তাহলে তাদের কোন পাপ হবে না। আর যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে অন্য কারো থেকে দুধ পান করাতে চাও, তাহলেও তোমাদের উপর কোন পাপ নেই, যদি তোমরা বিধি মোতাবেক তাদেরকে যা দেবার তা দিয়ে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।

পবিত্র কোরআনের সূরা আল-বাকারা অধ্যায় ২ আয়াত ২৬৫ এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন আরো ঘোষণা করে বলেনঃ وَ مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمُ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ اللّٰهِ وَ تَثۡبِیۡتًا مِّنۡ اَنۡفُسِهِمۡ كَمَثَلِ جَنَّۃٍۭ بِرَبۡوَۃٍ اَصَابَهَا وَابِلٌ فَاٰتَتۡ اُكُلَهَا ضِعۡفَیۡنِ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ یُصِبۡهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ অর্থঃ আর যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও নিজদেরকে সুদৃঢ় রাখার লক্ষ্যে সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা উঁচু ভূমিতে অবস্থিত বাগানের মত, যাতে পড়েছে প্রবল বৃষ্টি। ফলে তা দ্বিগুণ ফল-ফলাদি উৎপন্ন করেছে। আর যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি নাও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টি (যথেষ্ট)। আর আল্লাহ তোমরা যা আমল কর, সে ব্যাপারে সম্যক দ্রষ্টা।

উপরোক্ত কুরআনের আয়াতগুলোর আলোকে সহজে উপলব্ধি করা যাই যে, বান্দার প্রার্থনা শুনতে বা বান্দার মনের অবস্থা বুঝার জন্য মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের নিকটবর্তী আসমানে আসার কোনই প্রয়োজন নেই। তাই সহীহ্ হাদিসে যতটুকু বর্ণিত আছে আমরা ততটুকুই সরল ভাবে বিশ্বাস করব। আল্লাহর এ বিশেষন কোনভাবেই কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নয়। আর যেহেতু আল্লাহ রব্বুল আলামীন কেন অবতরণ করেন, কিভাবে অবতরণ করেন বা এর স্বরূপ কী রাসুলল্লাহ (সাঃ) আমাদের বলেন নি, সেহেতু এগুলি নিয়ে প্রশ্ন করা বা উত্তরের সন্ধান করা, কিংবা নিজ মর্জিমাফিক ব্যাখ্যা প্রদান করা দীনের মধ্যে নব-উদ্ভাবন বা বিদ’আত। কারণ সাহাবীগন কখনো এরূপ প্রশ্ন বা উত্তর সন্ধান করেন নি।

তিনি কীভাবে নেমে আসেন তা অজ্ঞাত। বিষয়টি অদৃশ্য জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। যা শুধুমাত্র আল্লাহর ইলমে রয়েছে। অতএব হাদিসে যেভাবে এসেছে সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে মুমিনদের। তাই এ শব্দকে আমাদের নেমে আসার মতো মনে করার সুযোগ নেই। ফুকাহায়ে কেরামের মতে, নেমে আসাকে যেসব অর্থ করা যেতে পারে সেগুলো হলো- ১ আল্লাহর হুকুম নেমে আসে। ২ রহমাতের ফেরেশতাগণ নেমে আসেন। ৩ আল্লাহর রহমত নেমে আসে। ৪ আল্লাহ তাআলার তাজাল্লী নেমে আসে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রাতে ঘুমের পাশাপাশি তাঁর ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *