ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: মাতৃভাষার মর্যাদা ইসলামে স্বীকৃত। মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। বায়হাকি শরিফের এক হাদিসে তাঁর আরবিপ্রীতির বিরল নজির পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘তোমরা তিন কারণে আরবদের ভালোবাসবে। প্রথমত, আমি আরবের। দ্বিতীয়ত, পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি। তৃতীয়ত, জান্নাতবাসীদেরও ভাষা হবে আরবি।’ এ কথায় মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।একইভাবে এর মাধ্যমে অন্যান্য ভাষার জনগোষ্ঠীর ভাষার গুরুত্বও বেড়েছে। মাতৃভাষার গুরুত্ব আমাদের কাছে আরও বেড়ে যায় যখন দেখি মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে তাঁর জাতির মাতৃভাষাতেই পাঠিয়েছি; যাতে তিনি আল্লাহ তাআলার বাণী সহজেই তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪)। মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুলের বাণীর মাধ্যমে মাতৃভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায়।
পৃথিবীর সব জনপদের মানুষের নিজ নিজ ভাষা রয়েছে, যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং প্রাত্যহিক জীবনে মনের অব্যক্ত বিষয়াবলি প্রকাশের ভাষা। মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে প্রথম সেই ভাষা শেখে বিধায় এর নাম দেওয়া হয়েছে মাতৃভাষা। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ৬ হাজারের বেশি ভাষার মধ্যে একেক জনপদের লোকজন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলে থাকে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য; জ্ঞানীদের জন্য এতে সুনিশ্চিত অনেক নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম: ২২) পৃথিবীর অপরাপর সব জিনিসের মতো মাতৃভাষার স্রষ্টাও স্বয়ং মহান আল্লাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের মনের ভাব-বর্ণনা (ভাষা) প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।’ (সুরা রহমান: ৩-৪)
মানবসমাজের অজ্ঞতা দূর করতে মহান আল্লাহ সময়ের ব্যবধানে তাঁর নির্বাচিত প্রিয় পাত্রদের প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা ও মর্যাদা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। মানুষ ও মানবতার সব অপ্রাপ্তি পরিপূরণে ও পার্থিব-অপার্থিব সার্বিক সফলতা অর্জনের মানসে নাজিল করা সব আসমানি গ্রন্থ নিজ নিজ পয়গম্বরের মাতৃভাষায় প্রচারিত হয়েছে। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক নবীকে তাঁর স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ)
আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.)-এর মাতৃভাষা ছিল ইবরানি, তাই এ ভাষাতেই মহান আল্লাহ তাওরাত কিতাব নাজিল করেছেন। একইভাবে হজরত দাউদ (আ.)-এর মাতৃভাষা ইউনানিতে জাবুর কিতাব, হজরত ঈসা (আ.)-এর মাতৃভাষা সুরিয়ানিতে ইঞ্জিল কিতাব আর সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবিতে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এই কোরআন বিশ্বজাহানের পালনকর্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেশতা জিবরাইল একে নিয়ে অবতরণ করেছে। আপনার অন্তরে, যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারী হতে পারেন। আর এ মহাগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়। নিশ্চয়ই এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাবগুলোয়।’ (সুরা শুআরা: ১৯২-১৯৬)।
মহানবী (সা.) মাতৃভাষাতেই পবিত্র কোরআনের বাণী প্রচার করেছেন। মাতৃভাষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে রয়েছে, ‘হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও।’ (সুরা হুজুরাত: ১৩)।
পৃথিবীর নানা জাতির বসবাস এবং তাদের মনোভাব প্রকাশের জন্য মাতৃভাষা রয়েছে। সেই মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলো আর ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বিশ্বের কিছু জাতিগোষ্ঠীর। কিন্তু বাঙালি জাতি কেবল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলার মানুষকে জীবনও দিতে হয়েছে। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন মোতাবেক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয়েছে অমর এক শোকগাথা; যেখানে শাহাদাতের সুধা পান করতে হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেককেই। বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের ভাষাকে মুক্ত করেছে; যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরও গভীরে নিয়ে গেছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের উচিত বিশুদ্ধ মাতৃভাষার চর্চা করা। বাংলাকে সব বিকৃতি থেকে রক্ষা করা।
মহানবী (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর ও শুদ্ধভাষী। তিনি কোনো দিন একটি অশুদ্ধ বা বিকৃত শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করেননি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শহীদদের অবদান এবং মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষাপ্রীতির অজস্র নজির সামনে রেখে এ বিষয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখতে পাই, আরবের অধিবাসীদের নীতিবিধান, জীবনবোধ ও সামগ্রিক আচার-পদ্ধতি সহজে বোঝার জন্যই আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হয়েছিল। আর তা আল্লাহ তাআলার এক বাণীতেও পরিষ্কার অনুধাবন করা যায়, ‘আমি একে আরবি ভাষায় কোরআনরূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পারো।’ (সুরা ইউসুফ: ২)
মহান আল্লাহর এই নির্দেশনার আলোকে আমাদেরও উচিত, সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার যথার্থ প্রচলন এবং বাংলা ভাষার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আনা। বাংলা ভাষার কবি, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, প্রতিবেদকসহ সংশ্লিষ্ট সবার উচিত তাঁদের রচনায় আমাদের শিশু-কিশোরসহ অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষের সহজে বোধগম্য হয় এমন শব্দাবলি ব্যবহার করা। ভিন্ন ভাষায় রচিত মূল্যবান বইপত্র সহজবোধ্য ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে উপস্থাপন বাঞ্ছনীয়। ধর্মীয়, নৈতিক ও শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধীয় সব রচনা মাতৃভাষায় ভাষান্তর হওয়া প্রয়োজন; যাতে ইসলামকে বুঝতে সহজ হয়, নৈতিক জ্ঞানে গুণান্বিত হওয়া যায় এবং বিদেশি রচনাবলির স্বাদ বাংলায় আস্বাদন করা যায়।
লেখক: অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়