বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় কুরআনের নির্দেশ

মোঃ মিজানুর রহমান: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবী। এ ব্যাপারে আল-কুরআনে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। প্রযুক্তি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিয়ামাত। সমগ্র বিশ্ব এমন একটি সময় অতিবাহিত করছে যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া জীবন ধারণ সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় তথা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করছে। বিশ্বব্যাপী গবেষকরা গবেষণা করে নতুন নতুন আবিষ্কারাদি আমাদের সামনে উপস্থাপন করছে। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সারা বিশ্বই একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে এক দেশের খবর চলে আসে অন্য দেশে। হাজার মাইল দূরে অবস্থানরত মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায় অনায়াসে। পৃথিবীর এই তাবৎ আবিষ্কার ও প্রযুক্তির এসব উন্নয়ন সবই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ নেয়ামত। যার শুকরিয়া আদায় করা প্রতিটি বান্দার জন্য আবশ্যক। কেননা আল্লাহ বলেন, لَئِن شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য নেয়ামত বাড়িয়ে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীমে রয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানের এক অপূর্ব নিদর্শনা। বিজ্ঞানের যে কোন শাখার স্পষ্ট তথ্য কুরআন থেকে লাভ করা সম্ভব। বিজ্ঞান সম্পর্কে কুরআনে অসংখ্য আয়াত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তিনি মানুষকে বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা করার তাগিদ দিয়েছেন। তাই ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। দুনিয়াবী জীবনকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেনি, বরং সুস্থ সুন্দর জীবনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ “বল, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে নিষিদ্ধ করেছে?”

ইসলামে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে- قُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا “বলুন হে আমাদের রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর।” পড়া ও লেখা উভয় মাধ্যমই জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অতীব জরুরী। পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম বাণী হচ্ছে : اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ. اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ. الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ. عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ “পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।”

হাদীসেও জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন- আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الجَنَّةِ “যে ব্যক্তি ইলম (জ্ঞান) অর্জন করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন।”

আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘য়ালা যে সব উদাহরণ পেশ করেছেন, দৃষ্টান্ত দিয়েছেন তা অনুধাবনের জন্যও জ্ঞানী হওয়া প্রয়োজন। ইরশাদ হয়েছে: وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ “আর এসব দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য পেশ করি আর জ্ঞানী লোকেরা ছাড়া কেউ তা বুঝে না।”

এছাড়াও আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখতে সারাবিশ্ব পরিভ্রমণের নির্দেশ দিয়ে বলেন,قُلْ سِيْرُوْا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوْا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ثُمَّ اللهُ يُنْشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ “বল, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর। অতঃপর দেখ কীভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পরবর্তী সৃষ্টি করবেন।”

আবার এ কথাও উল্লেখ আছে যে, الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا “যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ মÐলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং বলে হে আমাদের রব, তুমি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করনি।”

জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আকল বা বিচার-বুদ্ধি ও ফিকর বা চিন্তা-চেতনার গুরুত্ব অত্যধিক। এ সম্পর্কে আল-কুরআনের নির্দেশনা এসেছে যে, أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ مَا خَلَقَ اللهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُسَمًّى وَإِنَّ كَثِيْرًا مِنَ النَّاسِ بِلِقَاءِ رَبِّهِمْ لَكَافِرُوْنَ “তারা কি তাদের অন্তরে ভেবে দেখে না যে, আল্লাহ নভোমন্ডল, ভূমÐল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন সত্য সহকারে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য? কিন্তু অনেক মানুষ তাদের পালনকর্তার সাথে সাক্ষাতে অবিশ্বাসী।”

জ্ঞান-বিজ্ঞানের এহেন গুরুত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যযুগের মুসলমানরা আপন হৃদয়ের জ্ঞানরূপ আলোকবর্তিকা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেন। পৃথিবীর সকল জ্ঞানভাÐার আহরণ করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। মুসলিম বৈজ্ঞানিকরা লোহাকে সোনা করার অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন যদিও তা সম্ভব হয়নি তথাপি এ গবেষণা সূত্রপাত করে নব নব উপাদান আবিষ্কারের। খলিফা মনসুর, হারুন-অর রশীদ, মালিক শাহ ও মামুনের সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা চরমে পৌঁছেছিল। বাগদাদ, মিশর, মরক্কো, স্পেন, পারস্য, সিসিলি, গ্রানাডা প্রভৃতি স্থান ছিল সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক, বিজ্ঞান, বীজগণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসা শাস্ত্র, সামরিক শিক্ষা, তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, শিল্পকলা, নৌবিদ্যা, শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি শিক্ষা লাভের প্রাণকেন্দ্র। সংক্ষেপে বলতে গেলে ইউরোপে যখন জ্ঞানের আলো পৌঁছেনি তখনও আরববাসী জ্ঞান-বিজ্ঞানে ছিলেন অনেক অগ্রগামী।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *